১৭৮০ সালে কলিকাতাতে আলিয়া মাদ্রাসার বুনিয়াদ রাখা হয়। নানা পরিবর্তনের মাধ্যমে অবশেষে ওয়েলেসলী স্কোয়ারে মাদ্রাসার ইমারত প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এখানকার উলামারা ভারত বর্ষকে ‘দারুল হরব’ বলে বিশ্বাসী ছিলেন। সুতরাং ছাত্রগণও ঐভাবে শিক্ষিত হতে থাকে।
.
অতঃপর মুসলিম জাতির হাত থেকে প্রশাসন বিভাগ হস্তান্তরিত করবার পালা আসে। পূর্বে মাদ্রাসার শিক্ষিত ছাত্ররাই কাজী, এসেসর ও জজ ইত্যাদি পদে নিযুক্ত হতো। পরে তাও না হওয়ার ব্যবস্থা গৃহীত হয়। বাহ্যত মাদ্রাসা সংস্কারের নামে নানা কমিটি ও সুপারিশ গৃহীত হতে থাকে।
.
কিন্তু ধীরে ধীরে মুসলমানদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দুর্বল করার ব্যাপারে সকল প্রচেষ্টা চালানো হয়। জীবিকার ক্ষেত্রে মাদ্রাসার ছাত্ররা যাতে একটা পথ খুঁজে পেতে পারে এজন্য আলিয়া মাদ্রাসাতে ‘ইলমে ত্বিব’ সিলেবাসভুক্ত করারও প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেন। শেষাবধি শুধু ধর্মশিক্ষার জন্যই এই মাদ্রাসা কোনোরকমে টিকে থাকে।
.
প্রকৃতপক্ষে আলিয়া মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাই ছিল মুসলমানদের আসল শিক্ষার মাধ্যম। কিন্তু কালক্রমে ইংরেজরা এর পাশাপাশি একটি বিকল্প শিক্ষা হিসেবে ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলে। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার এক শতাব্দী পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এবং সামগ্রিকভাবে ইংরেজি এই দেশের রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হয়।
এভাবে মুসলমানরা ধীরে ধীরে রাজ্যহারা, ধনহারা, মান-সম্মানহারা হয়ে এমন দরিদ্র জাতিতে পরিণত হয়, যা কোনোদিন তারা কল্পনা করতে পারেনি। এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভাষা হিসাবে ফারসি, আরবি ইত্যাদি ছিল এবং ভালোভাবে এর শিক্ষাসূচিতে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থাও ছিল। মূলত তা ছিল ধর্মভিত্তিক, এমনকি হিন্দুদের শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল ধর্মভিত্তিক। তাই বিদেশি ভাষার মাধ্যমে নৈতিকতাহীন শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণে মুসলমান কিছুতেই রাজী হয়নি। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু মুসলমান ইংরেজি পড়তে বাধ্য হয়েছে এবং ইংরেজি শিখে তাদের গোলাম হয়েছে। এ ব্যাপারে আকবর ইলাহাবাদী তাঁর ভাষায় বলেন:
“আহবাবা কেয় নুমাযাঁ কর গ্যায়ে
বি. এ. কিয়া, নওকর হুয়ে, পেনশন মিলি আওর মর গ্যায়ে।”
বন্ধুগণ কী কীর্তিই না করলেন! বি.এ. পাস করার পর, ইংরেজের চাকর হলেন, চাকরির অবসানে পেনশন পেয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন-বর্জিত এই শিক্ষাব্যবস্থার পরিণতি এ ছাড়া আর কি হতে পারে?
রিয়াদুল হাসান
লেখক, কবি ও সাহিত্যিক।
(ইয়াকুব শরীফ, সাবেক অধ্যক্ষ, ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসা)